আমাদের শহর জ্যামের শহর। দেশের বেশিরভাগ গাড়ি মূলত ঢাকার রাস্তাতেই চলে। একটু চলা, একটু থামা , এভাবেই পথচলা। আবার গাড়ি ছাড়াও যে চলা সম্ভব তা-ও কিন্তু না। আমাদের প্রয়োজনের খাতিরে আমরা গাড়ি কিনি। কারো ব্যক্তিগত প্রয়োজন কারো আবার রোজগারের মাধ্যম। বাজারে বর্তমানে অনেক ধরণের গাড়ি পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি দেশের বাইরে জনপ্রিয়তা পেলেও আমাদের দেশে তেমনভাবে চালু হয়নি। অন্যদিকে ফুয়েল চালিত ইঞ্জিনের গাড়িগুলোকে নন-হাইব্রিড এবং জ্বালানি শক্তির পাশাপাশি বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করা গাড়িগুলোকে হাইব্রিড গাড়ি ধরা হয়।
হাইব্রিড গাড়িগুলো ব্যাটারির শক্তিকে প্রাথমিক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। আর জ্বালানি তেলের শক্তিকে দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। তাই জ্বালানি খরচ অনেকটা কমে আসে। মজার ব্যাপার হচ্ছে গাড়িতে দুই শক্তি-ই প্রয়োজন অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। মানে ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইঞ্জিন চালু হয়ে যায়। সাধারণ গাড়িতে জ্বালানি তেলের যে অপচয় হয়। তা হাইব্রিড গাড়িতে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। মানে অপচয়ের কোন শঙ্কা থাকছে না।
জ্যামের গল্পে আবার ফিরে আসি। একটা গাড়ি যখন বারবার জ্যামে কিংবা সিগন্যালে আটকা পড়ে তখন গাড়ি কিন্তু চালুই থাকে। ফলে ফুয়েলের অপচয়, খরচ বেড়েই চলে। এ অভিজ্ঞতা মোটেও নতুন কিছু না আমাদের জন্য। এদিকে হাইব্রিড গাড়ির খরচের হিসাব নিয়ে দৈনিক দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদনে এসেছে, “কোনো কোনো গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দাবি করে থাকে হাইব্রিড গাড়িতে তেল খরচ প্রায় অর্ধেক হয়। গাড়ির শক্তি বা কার্যক্ষমতাকে হ্রাস না করে যে সুবিধা হাইব্রিড গাড়ি প্রদান করে তা সাধারণ গাড়ি পারে না”।
যেসব সুবিধা পাবেন হাইব্রিড গাড়িতেঃ
কমবে জ্বালানি খরচ
গাড়ি কেনার পর বড় যে চিন্তাটা সেটা হচ্ছে ফুয়েল খরচ নিয়ে। হাইব্রিড গাড়ি সেটা অনেকটা কমিয়ে আনে। সাধারণ গাড়ির ক্ষেত্রে ১ লিটার তেলে গাড়ি যতটুকু চলে হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রে সেটুকু তেলে ৭ থেকে ৯ কিলোমিটার বেশি চলে। আবার যখন ব্যাটারি থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে মোটরে গাড়ি চলে তখন ইঞ্জিন বন্ধ থাকে। সেই সাথে ফুয়েল লাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যানজটের সময়ও ব্যাটারি কার্যকরী ভূমিকা রাখে এবং ফুয়েলের অপচয় রোধ করে। জ্বালানি শক্তির অপচয়ের কোন সম্ভাবনা থাকে না হাইব্রিড গাড়িতে।
টানবে খরচের লাগাম
সাধারণ গাড়ির ক্ষেত্রে জ্বালানির সঙ্গে সম্পর্কিত যন্ত্রাংশের পিছনে বেশ দীর্ঘ একটা ব্যয়ভার থাকে। হাইব্রিড গাড়ি যেহেতু মোটরের সাহায্যেও চলে তাই ইঞ্জিনের কন্ডিশন দীর্ঘমেয়াদী হয়। ইঞ্জিন অয়েল, অয়েল ফিল্টার এবং এয়ার ফিল্টার এগুলোর ব্যবহার কমে আসে। ফলে নন-হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রে যেখানে ৩ হাজার কিলোমিটার পরপর বদলাতে হয় সেখানে হাইব্রিড গাড়িতে সেগুলো ৫ থেকে ৬ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। জ্বালানির সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেকটা যন্ত্রাংশের আয়ু প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
কমবে পরিবেশ দূষণ
বৈদ্যুতিক গাড়ির মত হাইব্রিড গাড়িও বিশ্বে পরিবেশ বান্ধব হিসেবেই জনপ্রিয়। হাইব্রিড গাড়ি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড কম নির্গত হয়। ফলে খুব একটা পরিবেশ দূষিত হয় না। যখন গাড়ি ব্যাটারি শক্তিতে চলে তখন গাড়ি থেকে কোন ধরণের কালো ধোঁয়া বের হয় না, ইঞ্জিনও বন্ধ থাকে। পরিবেশের উপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়ে না তখন।
রূপান্তরের ঝামেলা নেই
নন-হাইব্রিড গাড়ির জ্বালানি খরচ বাঁচাতে সিএনজি বা এলপিজিতে রূপান্তর করা হয়ে থাকে। হাইব্রিড গাড়িতে বিকল্প শক্তি হিসেবে ব্যাটারি ব্যবহৃত হওয়াতে এসব রূপান্তরের ঝামেলা নেই। নেই লাইনে দাঁড়িয়ে গ্যাস নেওয়ার প্রতিযোগিতা। রূপান্তরের খরচটাও বেঁচে যায়। অটোমোবাইল নির্মাতারা যেভাবে গাড়ি তৈরি করে, সেভাবেই গাড়ি চলাতে ইঞ্জিনও হয় দীর্ঘস্থায়ী।
বৈদ্যুতিক চার্জে চালানোর সুবিধা
হাইব্রিড গাড়ির মধ্যে প্লাগ ইন হাইব্রিড (পিএইচইভি) গাড়িগুলো শুধু ব্যাটারির সাহায্যে চালানো সম্ভব হয়। এগুলোর জন্য আলাদা করে ব্যাটারি চার্জ করার ব্যবস্থা থাকে এবং বাসাবাড়ি থেকেই চার্জ করা যায়। এক চার্জে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারে ইঞ্জিন চালু না করেই। ফলে অল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে ফুয়েল খরচের জন্য কোন চিন্তাই করতে হয় না। তবে, সব হাইব্রিড গাড়িতে এই সুবিধা থাকে না।
হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রে যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেনঃ
চড়া দাম
হাইব্রিড গাড়ির ক্রয়মূল্য স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য গ্যাসচালিত গাড়ির তুলনায় অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে গাড়ি কেনার সময় ক্রেতাদের এককালীন বেশ মোটা অংকের টাকা গুনতে হবে। তবে কেনার পর যেহেতু খরচের মাত্রা কমে আসবে সেক্ষেত্রে অনেকে ব্যয়ভারটা বহন করতে আগ্রহী হয়।
দক্ষ টেকনেশিয়ানের অভাব
হাইব্রিড গাড়ি নতুন প্রযুক্তির হওয়ায় আমাদের টেকনেশিয়ানরা এখনো এটির সাথে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারেননি। ঢাকার মধ্যে দক্ষ মিস্ত্রি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বাইরের শহরগুলোতে সেটা খুব কম। ফলে গাড়িতে কোন সমস্যা দেখা দিলে সেটা নিয়ে ভালোই বেগ পোহাতে হয়। দ্রুত সমাধান পাওয়াটা মুশকিল হয়ে পড়ে।
গতি কম
সাধারণ ইঞ্জিনচালিত গাড়ির মত হাইব্রিড গাড়ি দ্রুত চালাতে পারবেন না। আবার বেশি গতি তুলতে গেলেও জ্বালানি খরচের মাত্রা বেড়ে যাবে। ফলে হাইব্রিড গাড়ির যে উপকারিতা সেটা ব্যহত হবে। যা মূলত হাইব্রিড গাড়ির লক্ষ্য নয়। কারণ এতে খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশেরও ক্ষতি হবে।
রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি
হাইব্রিড গাড়ির ব্যাটারির মূল্য প্রায় দুই হাজার মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। কোন কারণে ব্যাটারিতে সমস্যা দেখা দিলে এবং সেটি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়লে আপনার পকেটের উপর দিয়ে ছোটখাটো ঝড় বয়ে যেতে পারে। অবশ্য অনেক হাইব্রিড গাড়ির ব্যাটারির জন্য ১০ বছর/১,৫০,০০০ মাইল ওয়ারেন্টি দেওয়া হয়ে থাকে। গাড়ির মডেল অনুযায়ী ওয়ারেন্টি এবং মাইলেজ পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
অন্যান্য গাড়ির মত হাইব্রিড গাড়িরও কিছু ত্রুটি রয়েছে। তবে যেহেতু অসুবিধার থেকে সুবিধা বেশি তাই সেগুলো উপেক্ষা করা যায়। এছাড়াও নতুন প্রযুক্তি আর পরিবেশের ব্যাপারটা মাথায় রাখলেও হাইব্রিড গাড়িকে এগিয়ে রাখতে হবে।