প্রযুক্তি উন্নয়নের এই সময়ে সব কিছুর সাথে যানবাহনেও আসছে পরিবর্তন। পরিবেশ সুরক্ষায় ইতোমধ্যেই উন্নত দেশগুলোতে গ্যাস বা ডিজেল চালিত গাড়ির সংখ্যা কমানোর চিন্তা চলছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয় এমন গাড়ির পরিবর্তে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা বাড়ছে। পরিবেশ বান্ধব এই বৈদ্যুতিক গাড়ি দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির ধারনা যেহেতু এখনও নতুন; জনমনে এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা কৌতুহল।
বৈদ্যুতিক গাড়ির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে জেনে নেওয়া যাক।
বৈদ্যুতিক গাড়ি কি?
বৈদ্যুতিক গাড়ি বা EV মূলত বৈদ্যুতিক মোটর দ্বারা চালিত এমন একটি যানবাহন যা ব্যাটারি থেকে বিদ্যুৎ টানে এবং যার শক্তি সঞ্চারণ হয় এতে স্থাপিত রিচার্জেবল ব্যাটারি দ্বারা। এই গাড়িগুলোতে ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিন (Internal-Combustion Engine) এর পরিবর্তে রিচার্জেবল ব্যাটারি স্থাপিত হয়; যার কারনে কোন প্রকার জ্বালানি শক্তি ব্যবহৃত হয় না। এই গাড়িগুলো থেকে কার্বন নির্গমন তাই নেই বললেই চলে।
বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রকারভেদঃ
বৈদ্যুতিক গাড়িও বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে—
(১) ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি বা BEVঃ ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি সম্পূর্ণভাবে বৈদ্যুতিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই গাড়িতে ব্যাটারি ছাড়া আর কোন ইন্টারনাল কম্বশ্চন থাকে না।
(২) হাইব্রিড বৈদ্যুতিক গাড়ি বা HEVঃ এই গাড়িগুলো ইন্টারনাল কম্বাশচন ইঞ্জিন এবং বৈদ্যুতিক ব্যাটারি– দুটোই ব্যবহার করে থাকে। জ্বালানি শক্তির পাশাপাশি বৈদ্যুতিক শক্তিও এই গাড়িতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
(৩) প্লাগ-ইন হাইব্রিড বৈদ্যুতিক গাড়ি বা PHEVঃ এটি হাইব্রিড গাড়ির মতোই। প্লাগ-ইন গাড়ির ব্যাটারি তুলনামুলকভাবে বড় এবং বাহ্যিকভাবে চার্জ দেওয়া যায়।
(৪) মাইল্ড-হাইব্রিড বৈদ্যুতিক গাড়ি বা MHEVঃ এ ধরনের গাড়িগুলো খুবই ছোট ইলেক্ট্রিক মোটর ব্যবহার করে থাকে। এ ধরনের গাড়িতে বৈদ্যুতিক শক্তি কোন কাজে আসে না। গতানুগতিক পেট্রোল চালিত গাড়ির তুলনায় এটি মসৃনভাবে চলাচল করতে পারে।
(৫) ফুয়েল-সেল বৈদ্যুতিক গাড়ি বা FCEVঃ এই গাড়িগুলোর আরেক নাম হাইড্রোজেন গাড়ি। এই গাড়িগুলোতে হাইড্রোজেন সেল এর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন করে তা ব্যাটারিতে জমা করা হয়। ব্যাটারি থেকে তারপর বৈদ্যুতিক শক্তি সরবারহের মাধ্যমে গাড়ি চালানো হয়। এই ধরনের গাড়িগুলো তুলনামূলকভাবে একটু ব্যয়বহুলই বটে। তাছাড়া, হাইড্রোজেন ফুয়েল স্টেশন সবজায়গায় দেখা যায় না বলে এই ধরনের গাড়ির চাহিদা কম।
বৈদ্যুতিক গাড়ির সুবিধাঃ
পরিবেশবান্ধবঃ বৈদ্যুতিক গাড়ি গ্যাস ও তেলচালিত গাড়ির তুলনায় অধিকতর পরিবেশবান্ধব। বৈদ্যুতিক গাড়িতে যেহেতু কোন ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয় না, তাই এ গাড়িগুলো থেকে কার্বন ও ধোঁয়া নির্গমন হয় না বললেই চলে।
নিরাপত্তাঃ বৈদ্যুতিক গাড়িতে ইন্টারনাল কম্বাশ্চন ইঞ্জিন না থাকার ফলে দূর্ঘটনা ঘটে গাড়ি ব্লাস্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম।
চালানো সহজঃ বৈদ্যুতিক গাড়িতে গিয়ার থাকে না এবং এটি চালানো খুবই সহজ।
অধিক সাশ্রয়ীঃ পেট্রোল বা ডিজেল চালিত গাড়ির তুলনায় বৈদ্যুতিক গাড়ির খরচ কম হয়ে থাকে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি চার্জ দিতে শুধু বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। নবায়নযোগ্য এনার্জি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খরচও কমানো যায়; যেমনঃ সোলার প্যানেল।
রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমঃ গ্যাসচালিত যানবাহনের তুলনায় বৈদ্যুতিক গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম। কেননা, বৈদ্যুতিক গাড়ির তেল পরিবর্তন বা এয়ার-ফিল্টার প্রতিস্থাপন করা লাগে না। গ্যাস চালিত গাড়ির তুলনায় বৈদ্যুতিক গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে ৩৩০ ডলার কম ব্যয় হয়।
শব্দদূষণ হ্রাস পায়ঃ শব্দদূষণ একটি নীরব ঘাতক। এই সমস্যা মোকাবেলায় ইলেক্ট্রিক গাড়ি হতে পারে দারূন সমাধান। বৈদ্যুতিক গাড়িতে কোনো ধরণের ইঞ্জিন না থাকায় এগুলো চলাচলে কোন ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয় না।
চার্জিং স্টেশনের স্বল্পতাঃ বৈদ্যুতিক গাড়ি বাসায় বসে চার্জ দেওয়া গেলেও তা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া, পাওয়ার স্টেশনের স্বল্পতা তো রয়েছে ই। উন্নত দেশগুলোতেও এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত পাওয়ার স্টেশন নেই।
গতি কমঃ বৈদ্যুতিক গাড়ির গতি সাধারণত ইঞ্জিন চালিত গাড়ির চেয়ে কম হয়ে থাকে। সর্বোচ্চ গতির বৈদ্যুতিক গাড়ি Maserati GranTurismo Folgore এর গতিও ঘন্টায় ২৯৯ মাইলেজ ।
চড়া দামঃ বৈদ্যুতিক গাড়ির জ্বালানি খরচ অনেক কম হলেও এর ক্রয়মূল্য অনেক বেশি। এর চড়া দামের কারণে ক্রেতারা এটি কিনতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
রিচার্জ করতে সময় বেশি নেওয়াঃ ইঞ্জিনচালিত গাড়ির চেয়ে বৈদ্যুতিক গাড়িতে রিচার্জ করতে সময় বেশি লাগে। গাড়িভেদে বৈদ্যুতিক গাড়ি রিচার্জ করতে ২০ মিনিট থেকে ৬ ঘন্টাও লেগে যেতে পারে।
বৈদ্যুতিক গাড়ির ভবিষ্যৎঃ
সারাবিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন প্রতি বছরই বাড়ছে; তবে এটির ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বৈদ্যুতিক গাড়ি জনপ্রিয় হবার কারণ– এর পরিবেশবান্ধবতা। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে অডির অনুমোদিত প্রতিনিধি প্রোগ্রেস মোটরস ইমপোর্টস লিমিটেডের বিপণন ব্যবস্থাপনা আবদুল্লাহ আর রাকিব এর মতে, “ বৈশ্বিক উষ্ণতা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, কালো ধোঁয়া নির্গমন এবং আরও অনেক সমস্যার সমাধান রয়েছে বৈদ্যুতিক গাড়ির কাছে। বিশ্বের মধ্যে বাষুদূষণের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান সবার ওপরের দিকে। তাই ঢাকার মতো শহরের জন্য বৈদ্যুতিক গাড়ি বড় সুবিধাই হতে পারে।” বৈদ্যুতিক গাড়ির কার্বন ফুটপ্রিন্ট হয় না বলে দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব। শুধু একটি বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহারই বছরে গড়ে ১.৫ মিলিয়ন গ্রাম CO2 কমাতে পারে।
বৈদ্যুতিক গাড়ি পরিবেশের জন্য ভালো হলেও এটির দাম অনেক চড়া। প্রতিনিয়ত চার্জ দেওয়ার ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি প্রতিস্থাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে আস্তে আস্তে এটির দামও কমে আসবে।
বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং স্টেশনের স্বল্পতা থাকলেও ব্যক্তি পর্যায়ে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। চার্জিং স্টেশন বাড়লে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার আরো বাড়বে। বাংলাদেশ সরকারের অটোমোবাইল নীতি অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব যানকে পরিবহনব্যবস্থায় বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাছাড়া , ২০২৩ সাল নাগাদ অন্তত ১৫ শতাংশ নিবন্ধিত বৈদ্যুতিক গাড়ি লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে সরকারের।
বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার এক সময়ে স্বপ্ন মনে হলেও এটি এখন বাস্তব। পরিবেশবান্ধব হওয়ার ফলে এই গাড়ি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্যও আশির্বাদস্বরূপ। অদূর ভবিষ্যতে তাই বৈদ্যুতিক গাড়িই হতে পারে চলার সঙ্গী।